ভূমিকা
ডাল হলো শিম (leguminoseae) গোত্রের অর্ন্তগত খাদ্যশস্য। প্রায় ১১,০০০ বছর আগে আদি মানব সভ্যতার অন্যতম স্থান মধ্যপ্রাচ্যে ফারটাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলে ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদনের ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ডাল চাষের প্রচলন ছিল না। বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে আয©দের আগমনের সাথে সাথে এই অঞ্চলে ডাল চাষের প্রচলন শুরু হয়। ডাল একটি রবি শস্য মূলত সারাদেশে এর চাষ করা হয়। তবে বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, নোয়াখালি ও বরিশাল জেলায় ডাল চাষ বেশি হয়। বাংলাদেশের মানুষের সুষম খাদ্য পূরণের জন্য ডাল একটি গুরুত্বপূণ© ফসল এবং উদ্ভিজ্জ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস । এতে গমের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং চালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ প্রোটিন আছে। মাংস থেকে যে আমিষ পাওয়া যায় ডাল জাতীয় ফসল নিয়মিত খেলে তা পূরণ করা যায়। ডাল দামে সস্তা হওয়ায় ডালকে গরীবের আমিষও বলা হয়। এ ছাড়াও ডালে পর্যাপ্ত পরিমাণে শক©রা, চর্বি ও খনজি লবণ থাকে । বাংলাদেশে সব শ্রেণীর মানুষ আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য ডাল খেয়ে থাকেন। শুধু মানুষের খাদ্য নয়, পশুর খাদ্য ও মাটির গুনাবলী রক্ষার্থে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ডাল এদেশে গুরুত্বপূণ© ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশে বিগত বিগত দুই দশকে ডাল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ কমেছে কিন্তু উৎপাদন বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর ‘আঞ্চলিক ডাল গবেষণা কেন্দ্র, মাদারীপুরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর অঞ্চলে ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের “কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল,তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্প”-এর আওতায় কৃষক পর্যায়ে ডাল উৎপাদন বৃদ্ধির কাযক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন উপযোগী প্রধান ডাল ফসলসমূহ:
সুষম খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডাল একটি গুরুত্বপূণ© ফসল। বাংলাদেশে ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে প্রধানত: মসুর, ছোলা, মুগ, মাসকলাই, খেসারী, মটর, অড়হর এবং ফেলন আবদ হয়। পরিসংখ্যান তথ্য মতে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ১০৪০ হাজার একর জমিতে ৩৩৩ হাজর মে. টন ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয় (statistical year book, 2020) এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯১৯ হাজার একর জমিতে ৪২৫ হাজার মে. টন ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয় (statistical year book, 2021)। এখানে উল্লেখ্য যে, ডাল জাতীয় ফসলের আওতায় আবাদকৃত জমির পরিমান কমলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের সব এলাকায় ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয় তবে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও বগুড়া অঞ্চলে ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ বেশী হয়। পরিসংখ্যান তথ্য মতে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৩৩৩ হাজার একর জমিতে ১১৭ হাজার মে.টন মসুর, ৫৫ হাজার একর জমিতে ১৭ হাজর মে.টন মুগ, ৩১ হাজার একর জমিতে ১০ হাজর মে.টন ছোলা, ৫৮ হাজার একর জমিতে ১৭ হাজার মে.টন মাসকলাই, ০৪ হাজার একর জমিতে ১ হাজার মে.টন অড়হর এবং ৩৫২ হাজার একর জমিতে ১০৫ হাজার মে.টন অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮৬ হাজার একর জমিতে ১৮৬ হাজার মে.টন মসুর, ১০৯ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজার মে.টন মুগ, ১১ হাজার একর জমিতে ০৫ হাজার মে.টন ছোলা, ১০০ হাজার একর জমিতে ৩৭ হাজার মে.টন মাসকলাই, ০১ হাজার একর জমিতে ০.৪৭৪ হাজার মে.টন অড়হর এবং ৩৩৬ হাজার একর জমিতে ১৫৫ হাজার মে.টন অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয় (statistical year book, 2021)।
জলবায়ু ও মাটি
বাংলাদেশে রবি মৌসুমে বা শীতকালে ডাল জাতীয় ফসল চাষাবাদ করা হয়। কম তাপমাত্রা এবং শুষ্ক আবহাওয়া ডাল জাতীয় ফসল চাষাবাদের জন্য ভালো। সুনিষ্কাশিত দোআঁশ, বেলে দোআঁশ এবং এটেল দোআঁশ মাটিতে ডাল জাতীয় ফসল ভালো জন্মে। মাটির অম্লান (পিএইচ) ৬.৫-৭.৫-এর মধ্যে হলে ভালো হয়। ১৫-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ডালের অংকুরোদগমের জন্য উপযু্ক্ত।
ডাল ফসল চাষের গুরত্ব
ডাল ফসল বাংলাদেশে উদ্ভিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অভাব পূরণে, তৃনভোজী প্রাণির স্বাস্থ্য সুরক্ষায়, মাটির উর্বরা শক্তি ও জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধিতে ডাল জাতীয় ফসলের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রজাতিভেদে ডাল ফসলে আমিষের পরিমাণ ২০-৩৫%। রুই মাছ, মুরগির মাংস, গরুর দুধ, গমের আটা অপেক্ষা ডাল ফসলে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে। এই কারণে ডালকে গরীবের মাংস বলা হয়ে থাকে। মসুর ডাল অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রতিদিনের আহারে ব্যবহৃত হয়। খেসারি সাধারণত পশুখাদ্য হিসেবেই চাষ হয়, তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য হিসেবেও জনপ্রিয়। ছোলা ও মাষকলাই মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পদে রান্না করে খাওয়া হয়। তবে রমজান মাসে ইফতার হিসেবে ছোলা ও এর ডাল (ডালের বেশন) ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়ে থাকে।। এছাড়া ডাল থেকে নানা ধরনের খাবার তৈরি করা যায় যেমন খিচুড়ি, পিঁয়াজু, ঘুঘনি, চটপটি, ডালপুরি ইত্যাদি। ডাল বেটে শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয় বড়ি, যা গ্রামাঞ্চলের একটি পরিচিত খাদ্য৷ বিভিন্ন তরকারিতে এটি মিশিয়ে খাওয়া হয় ৷ ডাল থেকে নানা রকম মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যও তৈরি করা হয়। যেমন মুগের জিলিপি। শবে বরাতের দিন ডাল দিয়ে হালুয়া তৈরি করা হয়। তাছাড়া নিরামিষ খাদ্য তালিকায় ও ডাল অন্যতম আহারের পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে ডাল ফসল চাষের উপযোগিতা:
বাংলাদেশে রবি মৌসুমের অন্যতম ফসল ডাল জাতীয় ফসল। রবি মৌসুমে ফসলের ব্যাপকতা বেশী থাকায় অন্যান্য ফসলের সাথে প্রতিযোগীতায় ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন এলাকা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলের সবচেয়ে বেশী ডাল উৎপাদিত হয়। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া ও খুলনা অঞ্চলে ডাল জাতীয় ফসল আবাদ করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও উচ্চফলনশীল জাতের অভাব এবং দিন দিন লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও খড়া বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ডাল চাষ চাষাবাদ, সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া ডাল চাষাবাদে আয় তুলনামূলক অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম।
পরিবেশ সহিষ্ণু, স্বল্পমেয়াদি, উচ্চ ফলনশীল, জলবায়ু অভিযোজনশীল ডালবীজ জাতের সম্প্রসারণ এবং উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদের মাধ্যমে ডাল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব । বরিশাল ও ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনাবাদি ও একফসলি জমি ডাল আবাদের আওতায় নিয়ে আসলে ডালের আবাদকৃত এলাকা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দৈনিক খাদ্য তালিকায় চাহিদা-প্রাপ্তি
একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির উপর র্নিভর মাথাপিছু চাহিদা নির্ধারিত হয়। প্রয়োজনীয় শক্তির ৭০% আসে কার্বোহাইড্রেট বা শকরা থেকে, ২০% আসে ফ্যাট বা চর্বি থেকে এবং ১০% আসে প্রোটিন বা আমিষ থেকে । Yusuf et al, 1996 বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তি ২৩১০ কিলো ক্যালরি উপর ডাল ফসলের চাহিদা ৬৬ গ্রাম নির্ধারণ করেন, National Experts, 2007 দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তি ২৩৫০ কিলো ক্যালরি উপর ডাল ফসলের চাহিদা ৬০ গ্রাম নির্ধারণ করেন এবং DDP,2013 দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তি ২৪৩০ কিলো ক্যালরি উপর ডাল ফসলের চাহিদা ৫০ গ্রাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ডাল ফসলের চাহিদা ৫০ গ্রাম । Bangladesh Bureau of Statistics থেকে প্রকাশিত Report on Bangladesh Sample Vital Statistics জুন ২০২১ অনুসারে ১ জুলাই ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৮২২০০০০ জন। তাছাড়া বাংলাদেশে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৩ লক্ষ বিদেশী বসবাস করে। সুতরাং, ১ জুলাই ২০২০ সালে বাংলাদেশের অনুমিত জনসংখ্যা ১৬৯৭২০০০০ জন এবং ১ জুলাই ২০২১ সালে অনুমিত জনসংখ্যা ১৭২০২৪৮৯০ জন।
DDP,2013 অনুসারে মাথাপিছু ৫০ গ্রাম ডাল জাতীয় খাদ্যশস্য গ্রহণে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের ২০২০-২১ অর্থবছরে ডাল ফসলের মোট চাহিদা ছিল ৩১.৪০ লক্ষ মে.টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২০-২১ অথবছরে ৭.৯১৬৮৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৯,৩১২১০ লক্ষ মে. টন ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয় (কৃষি ডাইরি,২০২২) যার ২০% বীজ, গো-খাদ্য এবং যথাযথভাবে ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। ফলে ডাল জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি বছর বিদেশ থেকে ডাল জাতীয় ফসল আমদানী করতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং-এর তথ্য মতে ২০২০-২১ অথবছরে প্রায় ১০.১৬ লক্ষ মে. টন ডাল জাতীয় ফসল বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়।
বি:দ্র: ভারত ২০২০ সালে সুপারিশকৃত পুষ্টি গ্রহণ মাত্রা (আরডিএ) পূর্ণবিবেচনা করে নতুন ভাবে পুষ্টি উপাদানের চাহিদা প্রণয়ন করেছে। পাশ্চাত্য জনসংখ্যার তুলনায় এ অঞ্চলে জনগণের শারিরীক কাঠামোর ভিন্নতা এবং বেসাল বিপাক যথেষ্ট কম তা বিবেচনায় রেখে প্রাপ্ত বয়স্কদের খাদ্যশক্তি চাহিদার পরিবতন আরডিএ, ২০২০ ভারতে প্রতিফলিত হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য। আরডিএ, ২০২০ ভারত অনুসারে দৈনিক মাথাপিছু ডাল ও মাংস জাতীয় খাদ্য (প্রাণীজ খাদ্য) চাহিদা ১৫০ গ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে।